উত্তরঃ "তাবলীগ" অর্থ প্রচার করা, বার্তা পৌঁছে দেওয়া। তাবলীগ অর্থ কোনো দল না, যদিও বর্তমানে অনেক মানুষ মন করে তাবলীগ মানে একটা দল। তাবলিগ করতে হবে “কুরআন” ও “সুন্নাহর” (সহীহ হাদীস)। আল্লাহ তাআ'লা বলেছেনঃ "ইয়া আয়্যুহার-রাসুলু বাল্লিগ মা উনযিলা ইলাইকা মির-রাব্বিকা" অর্থঃ হে নবী! আপনি আপনার রব্বের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে তা প্রচার করুন। সুরা মায়িদাহঃ ৬৭। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ "বাল্লিগু আন্নি ওলাও আয়াহ"।
অর্থঃ তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটা আয়াত হলেও প্রচার করে দাও।
রাসুলের উপর নাযিল করা হয়েছে – কুরআন ও সুন্নাহ। সুতরাং একজন মুসলিম শুধু কুরআন ও সুন্নাহর তাবলীগ করতে পারে্। পীর-মুরিদীর ব্যবসা, নিজের তরীকা বা ফেরকা, বুজুর্গদের ভুয়া কিচ্ছা কাহিনী, ঈমান-আকীদা বিধ্বংসী কথা বার্তা ও জাল হাদীস, এইসব সে প্রচার করতে পারেনা। সুফীবাদীদের লেখা ভেজাল আমলের কিতাবের তাবলীগ করতে পারেনা।
তাবলীগ করতে হলে নিজে জেনে-শুনেই করতে হবে, অজ্ঞতা নিয়ে দাওয়াত দিতে গেলে তাবলীগ হবে, কিন্তু দ্বীনের তাবলীগ হবেনা। শিরক-বিদআ’তের তাবলীগ হবে। "(হে নবী আপনি) বলে দিনঃ এটাই আমার পথ। আমি আল্লাহর দিকে জেনে বুঝে দাওয়াত দেই, আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি মুশরেকদের অন্তর্ভুক্ত নই।"
সুরা ইউসুফঃ ১০৮। এই নিয়ম না মানার কারণে অনেক লোক আছে যারা তাবলীগ করার দাবী করে কিন্তু সে আসলে নিজের মনগড়া কাহিনী, জাল হাদীস, ভুয়া আমল, বেদাতী চিন্তা-ভাবনা ও কাজকর্ম প্রচার করে নিজেদের পরকালের ক্ষতি করছে, অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করছে। উপরোক্ত বিষয় মেনে দাওয়াতি কাজ করতে পারেন সমস্যা নেই।।
তিন রাকাত বিতির সালাতের সঠিক নিয়ম:
রাকআত বিতরের নিয়ম হল দুই প্রকারঃ
(ক) ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরে দিতে হবে। অতঃপর উঠে পুনরায় নতুন করে আরো এক রাকআত পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (ইবনে আবী শাইবা, ইর: ২/১৫০) ইবনে উমারও এইভাবে বিত্র পড়তেন। (বুখারী)
(খ) ৩ রাকআত একটানা পড়ে তাশাহ্হুদে বসতে হবে। তাতে আত্-তাহিয়্যাত ও দরুদ-দুআ পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩০৪, বায়হাকী ৩/২৮, ৩/৩১) এ ক্ষেত্রে মাগরেবের নামাযের মত মাঝে (২ রাকআত পড়ে) আত্-তাহিয়্যাত পড়া যাবে না। যেহেতু আল্লাহর রসূল (সাঃ) বিতরকে মাগরেবের মত পড়তে নিষেধ করেছেন। (ইবনে হিব্বান, সহীহ ২৪২০,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩০৪, বায়হাকী ৩/৩১, দারাক্বুত্বনী, সুনান ১৬৩৪নং)
এতদ্ব্যতীত ৩ রাকআত বিত্র মাগরেবের মত করে পড়া, (দারাক্বুত্বনী, সুনান ১৬৩৭নং) নতুন করে তাহ্রীমার তকবীর দেওয়ার মত (উল্টা) তকবীর দিয়ে পুনরায় হাত বেঁধে কুনূত পড়া ইত্যাদি কিছু সলফ কর্তৃক বর্ণনা করা হলেও তা সহীহ নয়। (ইর: ৪২৭নং, তুহ্ফাতুল আহওয়াযী ১/৪৬৪) অতএব তা বিদআত ও পরিত্যাজ্য।
মুশরিক ও বিদআতী ইমামের পিছনে নামায পড়ার বিধান:
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন ইবাদতে অন্য কোন সৃষ্টিকে শরীক করে, যেমন মাযার পূজা করে, মাযারে গিয়ে সিজদা, নযর-নিয়ায, মানত, কুরবানী, তওয়াফ প্রভৃতি নিবেদন করে, সেখানে সুখণ্ডসমৃদ্ধি বা সন্তান চায়, সাহায্য প্রার্থনা করে, যে ব্যক্তি গায়বী (অদৃশ্যের খবর জানার) দাবী করে ও লোকেরহাত বা ভাগ্য-ভবিষ্যৎ বলে দেয়, যে (কোন পশু বা পাখীর চামড়া, হাড়, লোম বা পালক দিয়ে, কোন গাছপালার শিকড় বা ফুল-পাতা দিয়ে, কারো কাপড়ের কোন অংশ দিয়ে, ফিরিশ্তা , জিন, নবী, সাহাবী, ওলী বা শয়তানের নাম লিখে অথবা বিভিন্ন সংখ্যার নকশা বানিয়ে, অথবা তেলেসমাতি বিভিন্ন কারসাজি করে, নোংরা ও নাপাক কোন জিনিস দিয়ে) শির্কী তাবীয লিখে, যে ব্যক্তি দুই জনের মাঝে (বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে) প্রেম বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য তাবীয করে, যোগ বা যাদু করে, এ শ্রেণীর ইমামের নামায শুদ্ধ নয়, ইমামতি শুদ্ধ নয় এবং তার পশ্চাতে নামাযও শুদ্ধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৫৯, ২২/৮২, ২৪/৭৮, ৮৯, ২৬/৯৭, ২৮/৫৫)
তদনুরুপ বিদআতী যদি বিদআতে মুকাফফিরাহ্ বা এমন বিদআত করে যাতে মানুষ কাফের হয়ে যায়, তাহলে সে বিদআতীর পিছনে নামায শুদ্ধ নয়।
কি চমৎকার সাহাবিদের ভালবাসা:
মৃত্যুর মুখে অপূর্ব ভ্রাতৃত্ব ! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ মুমিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজের জন্য যা ভালবাসে তার ভাইয়ের জন্য তা ভালবাসবে’ (বুখারী, ‘কিতাবুল ঈমান’)। ইয়ারমুক যুদ্ধের বিশাল ময়দান। এক প্রান্তে ক্ষুদ্র মুসলিম সেনাদল আর অপর প্রান্তে রোমক দলের বিশাল সৈন্য বাহিনী। উভয় দলই ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি দন্ডায়মান। যুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্তে আবূ ওবাইদাহ, মু‘আয বিন জাবাল আমর ইবনুল আছ, আবূ সুফিয়ান, আবু হুরায়রাহ প্রমুখ ছাহাবী সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হৃদয়গ্রাহী উপদেশ দেন। আবূ ওবাইদাহ উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,
‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন এবং পদযুগলকে স্থির করবেন। হে মুসলিম সেনাবাহিনী!
তোমরা ধৈর্যধারণ করো। কেননা ধৈর্য কুফরী থেকে বাঁচার, আল্লাহর সন্তুষ্টি
লাভের এবং লজ্জা নিবারণের উপায়। তোমরা তোমাদের যুদ্ধের সারি থেকে সরে
দাঁড়াবে না। কাফেরদের দিকে এক ধাপও অগ্রসর হবে না এবং আগ বেড়ে তাদের সাথে
যুদ্ধের সূচনা করবে না। শত্রুদের দিকে বর্শা তাক করে থাকবে এবং বর্ম দিয়ে
আত্মরক্ষা করবে। তোমাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা মনে মনে
আল্লাহর যিকির করতে থাকবে’। যুদ্ধ শুরু হ’ল এবং প্রচন্ড আকার ধারণ করল। যুদ্ধের সময়
হুযায়ফা (রাঃ) আহতদের মধ্যে তার চাচাতো ভাইকে খুঁজতে শুরু করলেন। তার সাথে
ছিল সামান্য পানি। হুযায়ফার চাচাতো ভাইয়ের শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তার
অবস্থা ছিল আশংকাজনক।
হুযায়ফা (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি পানি পান করবে? সে তার কথার কোন উত্তর দিতে সক্ষম না হয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত করল। আহত ব্যক্তি হুযায়ফার কাছ থেকে পানি পান করার জন্য হাতে নিতেই তার পাশে এক সৈন্যকে পানি পানি বলে চিৎকার করতে শুনল। পিপাসার্ত ঐ সৈনিকের বুকফাটা আর্তনাদ শুনে তার পূর্বে তাকে পানি পান করানোর জন্য হুযায়ফাকে ইঙ্গিত দিলেন। হুযায়ফা তার নিকট গিয়ে বললেন, আপনি কি পানি পান করতে চান? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
তিনি পান করার জন্য পাত্র উপরে তুলে ধরতেই পানির জন্য অন্য একজন সৈন্যের চিৎকার শুনতে পেলেন। তিনি পানি পান না করে হুযায়ফা (রাঃ)-কে বললেন, তার দিকে দ্রুত ছুটে যাও এবং সে পানি পান করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাকে দিয়ো। হুযায়ফা আহত সৈন্যটির কাছে গিয়ে দেখলেন, সে মারা গেছে।
অতঃপর দ্বিতীয় জনের কাছে এসে দেখলেন সেও মারা গেছে। অতঃপর চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফিরে আসলে দেখেন তিনিও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে জান্নাতবাসী হয়েছেন। পানির পাত্রটি তখনও হুযায়ফার হাতে। এতটুকু পানি। অথচ তা পান করার মত এখন আর কেউ বেঁচে নেই। যাদের পানির প্রয়োজন ছিল তারা আরেক জনের পানির পিপাসা মেটাবার জন্য এতই পাগলপরা ছিলেন যে, অবশেষে কেউ সে পানি পান করতে পারেননি। সবারই প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। অসামান্য ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের কারণে সবাই একে অপরের জন্য পানি ফিরিয়ে দিয়েছেন। কি অপূর্ব এ ভ্রাতৃত্ব! (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (কায়রোঃ ১৯৮৮), ৭/৮-১১ প্রভৃতি দ্রঃ)।